Magic Lanthon

               

ঋতুপর্ণ ঘোষ, মাধবী মুখোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর ও অপর্ণা সেন

প্রকাশিত ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘ম্যাজিক আড্ডা’

সত্যজিতের নায়িকারা

ঋতুপর্ণ ঘোষ, মাধবী মুখোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর ও অপর্ণা সেন


সংখ্যা ৬-এ ম্যাজিক আড্ডা বিভাগে আমরা প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মরণে পশ্চিমবঙ্গের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত আড্ডার ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করেছিলাম। আমরা মূলত সেই আড্ডার অডিও-ভিজ্যুয়াল আলোচনার একটি লিখিত রূপ দিয়ে পাঠককে ভিন্ন স্বাদ দিতে চেয়েছি। আমাদের সেই চেষ্টা সফল হয়। এ নিয়ে পাঠকদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পাই আমরা। তাই এবারে সত্যজিতের নায়িকারা শিরোনামে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা লিটারেরি মিট (২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি দেশি-বিদেশি লেখকদের সঙ্গে পাঠকের সেতুবন্ধন তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া নিয়মিতভাবে এরা ইতিহাস, খেলাধুলা, ভূ-রাজনীতি ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন আড্ডার আয়োজন করে) আয়োজিত একটি আড্ডার ভিডিও ইউটিউব থেকে সংগ্রহ করে সেটির ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করছি। আলোচনাটি দীর্ঘ হওয়ায় তা পর্বাকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবার থাকছে শেষ পর্ব। আগ্রহী পাঠকের যে কেউ চাইলে ইউটিউবে ঢু মেরে আসতে পারেন : পার্ট-১, https:/ww/w.youtube.com/watch?v=0MEhqakZX-I এবং পার্ট-২, https:/ww/w.youtube.com/watch?v=gR5UZV-tRvQ. [সম্পাদক]

 

শেষ কিস্তি

অপর্ণা : আমার সেক্ষেত্রে কোনো অসুবিধে হয়নি। একটা জায়গায় আমার অসুবিধে হয়েছিলো; সেটা হচ্ছে পিকুতে অভিনয় করার সময়। তখন এটা নিয়ে মানিক কাকার সঙ্গে আমার কথাও হয়। সুতরাং আই ডোন্ট ফিল ডিজলয়েল। মানিক কাকা আমায় বললেন যে, তুই কাঁদছিস ছেলের কথা ভেবে, যে ছেলে বাইরে ফুল আঁকছে আর বলছে, মা আমি কিন্তু কালো পেন্সিল দিয়ে সাদা ফুল আঁকছি¾সেটা খুব সুন্দর ছিলো।

ঋতুপর্ণ : না, মা, সাদা ফুল কালো পেন্সিল দিয়ে কী করে আঁকবো?

অপর্ণা : হ্যাঁ, যাই হোক ওরকম একটা কিছু। তখন কাকা আমাকে বললো, তুই কাঁদছিস, কারণ তুই ছেলেকে ঠকাচ্ছিস। আমি বললাম, না, আমি ছেলেকে ঠকাচ্ছি না তো; আমি ছেলেকে কখন ঠকালাম? আমি ওর বাবাকে ঠকাচ্ছি। কিন্তু কোথাও মানিক কাকার কাছে, মানে এটা দুই প্রজন্মের তফাত আর কি¾আমার মনে হচ্ছে, ওর বাবাকে ঠকাচ্ছি, মানিক কাকার মনে হচ্ছে বাবাকে ঠকানো মানেই ছেলেকে ঠকানো। এখানে কোথাও একটা আমার অসুবিধা হচ্ছিলো বুঝতে। তার পরও আমি কাঁদলাম, কারণ তখন আমরা ছবিতে কাঁদা-টাদাগুলো শিখে গেছি¾কীভাবে এগুলো করতে হয়। (দর্শকের হাসি)

কিন্তু আমি মানিক কাকাকে বলেছিলাম, এটা কী রকম লাগলো! কিন্তু উনি বললেন, বাবাকে ঠকাচ্ছো হ্যাঁ, ছেলেকেও। ওটা একটা এক্সটেনশন।

ঋতুপর্ণ : মানে ওটা একটা পরিবার, আসলে উনি হয়তো একটা পরিবারকে ঠকাচ্ছেন।

অপর্ণা : হয়তো তাই। আমার মনে হয়েছে, উনি একটু বিয়ের মধ্যে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক, সেটাতে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ ও সহজ ছিলেন। যেমন : অপুর সংসার। বিয়ের বাইরে যে সম্পর্ক, সেখানে উনি কখনো, মানে নারীর যে সেক্সুয়ালিটি সেটাকে এক্সপ্লোর করার জায়গায় একটু আনকমফোরটেবল ছিলেন¾আমার মনে হয়।

ঋতুপর্ণ : যেমন কোনো ফেলুদায় কোনো মেয়ে নেই।

অপর্ণা : আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একটা ইন্টারভিউতে। আমার বড়ো মেয়ে ডোনা আমাকে বলেছিলো, ওর গল্পে কোনো মেয়ে থাকে না কেনো? আমি মানিক কাকাকে বলেছিলাম, আমার মেয়ে কিন্তু ভীষণ নালিশ করছে, ফেলুদায় কোনো মেয়ে থাকে না কেনো? কারণ ডোনার প্রথম থেকে শেষ অবধি ফেলুদা পড়া, ও এখনো পড়ে। তখন তিনি [সত্যজিৎ] আমাকে বললেন যে, হ্যাঁ, এই নালিশটা আমার কাছে খুব আসে যে, মেয়ে নেই। কিন্তু আমি তখন ভাবি, তাহলে তোপসের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী হবে? (দর্শকের হাসি)

ঋতুপর্ণ : আবার গুপি গাইন বাঘা বাইন-এ, জাস্ট প্রথম ছবিটাতে দুই রাজকন্যা দুটি ট্রফির মতো এলো (দর্শকের হাসি), মানে একদম বিজ্ঞাপনের প্যাকশটের মতো শেষে দুইটা রাজকন্যা এলো এবং দ্বিতীয় গল্পে আমরা তাদের নাম শুনলাম, কিন্তু দেখতেও পেলাম না। আমার মনে হয়েছে যখনই উনি রূপকথা বা মনে করছেন এটা ছোটোদের ছবি, ছোটোরাও দেখবে, সেই ছবিটার মধ্যে উনি নারী-পুরুষের সম্পর্কটাকে খুব সতর্কভাবে এড়িয়ে গেছেন। এবং ফেলুদার সংসারটা¾ফেলুদা, তোপসে ও লালমোহন বাবু। একজন ইন্টেলিজেন্স, একজন কিউরিসিটি আর একজন হিউমার। এই তিনটে দিয়েই উনি একটা পরিবার তৈরি করছেন, সেখানে নারীর ইমোশনের প্রয়োজন নেই।

অপর্ণা : আর প্রথম চুম্বন দৃশ্যই তো এলো ঘরে-বাইরেতে।

ঋতুপর্ণ : দেবী ...।

অপর্ণা : সেটা তো মশারির মধ্যে! (দর্শকের হাসি)

ঋতুপর্ণ : তুই কি জানতিস (শর্মিলাকে লক্ষ্য করে) ওটা কিস করা হচ্ছে? তোকে বলা হয়েছিলো, এটা কিস করা হচ্ছে? তোমরা চুমু খাচ্ছো? ঘরে-বাইরেতে তো তিনটে চুমু ছিলো, তিনটা চুম্বন ...।

অপর্ণা : না, জানি। হ্যাঁ, উনি আমাকে বলেও ছিলেন কীভাবে নেবেন।

ঋতুপর্ণ : প্রথম দুটো সন্দীপের সঙ্গে, তৃতীয়টা নিখিলেশের সঙ্গে এবং এই চুম্বনের ভিতর থেকে তিনি পরিশুদ্ধ হয়ে উঠলেন।

শর্মিলা : স্টপ কাউন্টিং দ্য কিসেস। (সবার উচ্চস্বরে হাসি)

অপর্ণা : হোয়াই?

শর্মিলা : বিকজ আই থিঙ্ক, টেন মিনিটস ...।

ঋতুপর্ণ : কিন্তু শেষে বিমলাকে যে শাস্তিটা উনি দিলেন, একটা ন্যাড়া মাথা করে, মানে চুল কেটে ফেলে। তোর কি রিনা দি কোথাও মনে হয়েছে, পরমা যখন শেষে চুল কেটে ফেলে, মানে অ্যাডালট্রেসদের যে শাস্তি প্রাপ্য ...। পরমা কিন্তু বাইরের আবরণটা ঘুচিয়ে ফেলে একটা অন্তরের শক্তি পায়।

অপর্ণা : দুটোতেই অ্যাডালট্রেস-এর চেহারা দু-জন পরিচালক। আমি নিজেকে বাদ দিয়ে রাখছি ...।

শর্মিলা : এটা অ্যাডালট্রেস তো নয়, এটা বিধবা হবার জন্য।

ঋতুপর্ণ : যেনো বৈধব্যটা অ্যাডালট্রির শাস্তি।

অপর্ণা : অ্যাডালট্রির শাস্তি, কারণ ওর তো সন্দীপের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিলো, তাই না?

শর্মিলা : ছিলো নিশ্চয়ই, কিন্তু ...।

ঋতুপর্ণ : আমার শাস্তি হবেই, হবেই হবে ...।

শর্মিলা : যার সঙ্গে হার এনটায়ার সিকিউরিটি অ্যান্ড এভরিথিঙ কেম ফ্রম দ্য হাজবেন্ড। যেটা উনি অবজ্ঞা করেন, হোয়াটএভার রিজন, শি ওয়াজ লুকিং ফর স্বদেশি, শি ওয়াজ লুকিং ফর অ্যা কাইন্ড অব ইন্ডিপেন্ডেন্স; বাট উইথ দ্য ডেথ অব হার হাজবেন্ড, শি লস দ্যাট অ্যান্ড শি ওয়াজ পুশড ব্যাক। চুল কেটে বিধবা তখন হতো না, বিধবা হলে কী হতো সাদা শাড়ি পরে ...।

ঋতুপর্ণ : যেটা গোপাই চাঁদ সিন্ধু, ওর বড়ো জা-এর যা অবস্থা ...।

শর্মিলা : সো দ্যাট ওয়াজ নট পানিশমেন্ট ফর অ্যাডালট্রি। দ্যাট ওয়াজ, সোসাইটি হ্যাজ নো প্লেস ফর, নো রিকগনেশন ফর ...।

ঋতুপর্ণ : কিন্তু ছবিতে যেভাবে এসেছে, মানে উনি [বিমলা] নিজেই বলেন, আমার শাস্তি হবেই হবে।

শর্মিলা : ঠিক আছে, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইট লাইক দ্যাট অলসো, ইটস পসিবল। কিন্তু উনি যেটা দেখালেন সেটা তো সত্যি। তখন যেটা প্রথা ছিলো, বিধবার যেটা হলো। কিন্তু সেটাকে অ্যাডালট্রেস ভাবে কেনো দেখবো?

ঋতুপর্ণ : কারণ রবীন্দ্রনাথে বিধবা হওয়াটা নেই। এখানে বিধবা করে সত্যজিৎ, মানে আমরা ভিজ্যুয়ালি দেখলাম বৈধব্যটা।

শর্মিলা : ভিজ্যুয়ালি এটাও দেখলাম যে, দ্য উইম্যানস ইন্ডিপেনডেন্স ওয়াজ কানেকটেড উইথ হার হাজবেন্ড অ্যালাউয়িং হার টু ডু সো। দ্যাট ওয়াজ দ্য সোসাইটি। অন হার ওন, তুমি যাকেই দেখো, দে ওয়ার নট জ্ঞানদানন্দিনী, হোয়াটএভার, হু এভার ইউ সি, তাদের নিজেদের বলে কিছু ছিলো না তো। ইট ওয়াজ অলওয়েজ ট্রু ফর দ্য সোসাইটি।

ঋতুপর্ণ : স্বামীরা চেয়েছেন বাইরে আসো, তাই তারা বাইরে এসেছেন।

শর্মিলা : গাইডেড বাই দ্য পেট্রিয়াকল সোসাইটি।

মাধবী : সবসময় সোসাইটিই গাইড করে।

শর্মিলা : তখন তার [বিমলা] নিজের কোনো আলাদা আইডেনটিটি ছিলো না। যখন স্বামী মারা গেলেন, দ্যাট ওয়াজ দ্য এন্ড অব হার। কিন্তু তার আগে যখন বিধবাদের দেখাচ্ছেন ...।

অপর্ণা : কিন্তু সিনেমাতে ইমেজ তো একটা ভীষণভাবে কথা বলা জিনিস। তার মধ্যে অনেক কিছু ক্লিয়ার থাকে, অন্তত ভালো ছবিতে তো থাকেই। তো এখানে একটা লেয়ার হলো, অ্যাবসোলুটলি যেটা ম্যাটিরিয়াল রিয়েলিটি। আরেকটা লেয়ার হচ্ছে মেটাফরিক।

শর্মিলা : নিশ্চয়ই, সেটা তো তুমি যেভাবে ইন্টারপ্রেট করতে চাও, যেভাবে তুমি দেখতে চাও; মানে এখানে যারা যারা আছেন, ততগুলো মানে হতে পারে।

ঋতুপর্ণ : অতো সুন্দর একটা মনোলগ বিমলার; আমি তো ওটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম; প্রথমেই আগুন জ্বলছে, বন্দে মাতরাম-বন্দে মাতরাম; আগুন জ্বলছে সব জায়গায়; আস্তে আস্তে জানালার বাইরে আগুন, ক্যামেরাটা এসে বিমলার মুখে, বিমলা দেয়ালের গায়ে হেলান দেওয়া। তার গলা জড়ে আসে¾আমি আগুনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছি। যেটুকু পুড়বার ছিলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যেটুকু বাকি আছে তার আর মরণ নেই।

আমি সিনেমা দেখে ফিরে এসে ভাবলাম যে, এতো সুন্দর লাইন আমি মিস করলামটা কী করে, মানে আবার ‘ঘরে-বাইরে’ পড়লাম। তারপর দেখলাম এই লাইনটা নেই, এটা উনার [সত্যজিতের] লেখা। এবং তখন আমার মনে হয়েছিলো, রবীন্দ্রনাথকে কতোখানি ভালো করে পড়লে এই লাইনটা লেখা যায়। সেখানটাতেই ওর প্রতি আমার অসম্ভব একটা শ্রদ্ধা। আবার ঘরে-বাইরে স্ক্রিপ্টটা নিয়েও তার প্রতি আমার একটা শ্রদ্ধা আছে। ছবি বানানোটা, মানে তখন তিনি অসুস্থ, তাই সেটা দিয়ে বোধ হয় তাকে জাজ করা উচিত হবে না। একেকটা ছবির তো একেকটা গুণ থাকে; ঘরে-বাইরে স্ক্রিপ্টটা সত্যি খুব সুন্দর লাগে আমার। এবার আপনারা বলুন। (দর্শকের দিকে তাকিয়ে)

মাধবী : যেমন আরেকটা কথা বলি, শেষ ছবি যেটা করেছেন, আগন্তুক; আগন্তুক-এ মানুষের এই যে আইডেনটিটি, কী দিয়ে বিচার করা যাবে এটা¾পাসপোর্ট, ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, না কোনটা দিয়ে মানুষের বিচার করা হবে। এইটা নিয়ে যে একটা স্যাটায়ার; এর থেকে সুন্দর স্যাটায়ার বোধ হয় আর কিছু হতে পারে না।

ঋতুপর্ণ : এবার দর্শক।

দর্শক : আমার প্রশ্ন, আমরা সত্যজিৎ রায়ের সবকটা মুভি নিয়েই আলোচনা করলাম, কিন্তু একটা মুভি আলোচনায় এলো না, সেটা হচ্ছে নায়ক। সেখানে শর্মিলা ঠাকুর সাংবাদিকের যে চরিত্রটা করেছিলেন, সেটা করতে গিয়ে আপনার কী মনে হয়েছিলো¾সেটা যদি একটু বলেন।

ঋতুপর্ণ : অদিতি করবার সময় তোর (শর্মিলাকে লক্ষ্য করে) কী মনে হয়েছিলো? অদিতি নায়ক-এর জার্নালিস্ট।

শর্মিলা : মানে অদিতি সম্বন্ধে কী জানতে চান? (দর্শককে লক্ষ্য করে)

দর্শক : নায়ক-এ যখন আপনি সাংবাদিকের চরিত্র করছেন, তার আগে আপনি সীমাবদ্ধ করেছেন।

শর্মিলা : সীমাবদ্ধ পরে করলাম, নায়ক-এর পরে।

অপর্ণা : অপুর সংসার করেছেন; সেখানে বৈবাহিক সম্পর্ক, কিন্তু নায়ক-এ আপনি একেবারে একজন সাধারণ সাংবাদিক হিসেবে একজন বড়ো অভিনেতাকে দেখছেন। সেই সময় কীভাবে সত্যজিৎ রায় আপনাকে লাইক করেছিলেন ওই চরিত্রটা করবার জন্য? এটা যদি একটু বলেন?

দর্শক : এই চরিত্রটা সত্যজিৎ রায়ের অরিজিনাল চরিত্র।

শর্মিলা : সত্যজিৎ রায়ের লেখা এটা। উনার নিজের লেখা, নিজের স্ক্রিপ্ট, অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। আর ওখানে আমার যে চরিত্র, সেটা খুবই ভালো লেগেছে। তখন আমি প্রথম, মানে ঋতু তুমি বলছিলে না, আমি সবসময় বলি অপুর সংসার-এ আমাকে যেভাবে তিনি ডিরেক্ট করলেন, মানে এক পা এগিয়ে গেলে উপরে দেখো, কিন্তু তখন আমি তাকে অনেক কোয়েশ্চেন করেছি।

ঋতুপর্ণ : নায়ক-এর সময়?

শর্মিলা : হ্যাঁ, নায়ক-এর সময়। যখন উনি [সত্যজিৎ] আমাকে বললেন, চশমা পরো, তোমাকে উত্তমের এগেইনস্টে খুব ছোটো লাগবে; তখন আমি বললাম, ঠিক আছে, চশমা পরবো, তবে আমি কিন্তু শর্ট সাইটেট, ও লঙ সাইটেট? তখন উনি হঠাৎ থমকে গেলেন।

আমার চরিত্রটা খুবই ভালো লেগেছে নায়ক-এ। নায়ক-এ প্রথমে আমি যেভাবে উনাকে [উত্তম] প্রশ্ন করছি, খুব ক্রিটিকাল। তার পরে আস্তে আস্তে যেটা হয়েছে, ওর ওপর আমার একটা সমবেদনা, একটা সিমপ্যাথি তৈরি হয়েছে। যেটা খুব ভালোভাবে দেখানো হয়েছে ওখানে। লাস্ট সিনটা আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে, মানিক দা বোঝাচ্ছিলেন উত্তমকে এবং একপর্যায়ে ওই সিনটা তিনি করে দেখালেন। ওই ড্রাঙ্ক এবং নেক্সট টু দ্য ওপেন ডোর, দ্য রেলওয়ে ট্রাক ইজ পাসিং, ওকে [উত্তম] বললেন যে, ওকে [শর্মিলা] ডাকো। তারপর আমি এলাম; সেখানে ওর একটা ভীষণ বড়ো ডায়ালগ রয়েছে। সেটা মানিক দা করে দেখালেন।

আর উত্তম ডিড অ্যাবাউট ফিফটি পারসেন্ট অব মানিক দা, মানে যেটা তিনি [সত্যজিৎ] করে দেখালেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী দারুণ! মানিক দা যদি নিজে অভিনয় করতেন, জানি না তাহলে কী হতো? বাট উনি ডিসাইড করলেন যে সৌমিত্র, হি উইল বি দ্য স্পোক পারসন ফর হিম। সেটা আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে।

আরো অনেকগুলো ছোটো ছোটো ব্যাপার; অ্যাট দ্য লাস্ট, মানে একেবারে লাস্ট সিন-এ ওকে [উত্তম] সবাই ঘিরে ধরলো স্টার হিসেবে, আর আমি চলে গেলাম। সেটা খুবই দারুণ! সবাইকে একসঙ্গে করে একটা পসিবিলিটি অব সামথিং হ্যাপেনিং অ্যান্ড। সেটা, আই থিঙ্ক ইজ ডান ভেরি ওয়েল।

ঋতুপর্ণ : দুজনাই স্ট্রেঞ্জার হয়ে যায়, ইচ আদার।

দর্শক : আমি একটা কথা বলতে চাই, মাধবী দি বলছিলেন যে, এখন এই যে ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে, মানে এখনকার যে সিনেমা এবং আগেরকার যে সিনেমা; যাহোক যদিও আমার জন্ম ৭৪-এ, আমাদের মা, ঠাকুরমা বা দিদিমা’রা কিন্তু এখনো সেই সিডিগুলো কালেকশন করে, আমাদের দেখান। তারা বলেন, দেখো, এর মধ্যে কতো কিছু শেখার আছে। তোমরা যে এখন শুধু ফ্যাশনের দিকেই ঝুঁকছো, এখানে ফ্যাশনটা যেমন আছে, তার সাথে সাথে ফ্যাশনটা তুমি ঠিক কীভাবে করবে, সেই শিক্ষাটাও আছে। অতএব শর্মিলা দি যেটা বললেন, বিদেশে এই ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা হয়, কলকাতায় সার্বিকভাবে কতোটুকু হয় জানি না, কিন্তু এখনো আমাদের এমন কিছু ফ্যামিলি আছে, যারা এগুলো নিয়ে ঘরে আলোচনা করে, ওই সিডিগুলো দেখে।

মাধবী : ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের সবাইকে। আপনারা নিশ্চয়ই মহানগর দেখেছেন? ওখানে আমার যিনি শ্বশুর মশাই, তিনি বলেছিলেন, আগে যখন ওখানে ছিলাম তখন খুব ভালো ছিলাম। ওখানে বলতে কী, কোথায়?

দর্শক : পূর্ব বাংলা।

মাধবী : রাইট।

দর্শক : আমি একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে প্রশ্ন করছি, মঞ্চে যারা আছেন তারা সবাই আমার থেকে অনেক বড়ো; আমি জাস্ট বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করছি, অরণ্যের দিনরাত্রিতে আমি একটা জিনিস দেখেছিলাম, সেই মেমোরি গেমে যখন শর্মিলা ঠাকুর জিতে যান, সৌমিত্রকে হারিয়ে ...।

ঋতুপর্ণ : জেতেন না, জেতেন না।

দর্শক : মানে ইচ্ছে করে হেরে যান আর কি। এই যে মহিলাদের যে হারটা দেখানো হলো, মানে উনি হেরে গেলেন ইচ্ছে করে, এটা কি সত্যজিৎ রায় নিজে সত্যি সত্যি চাইতেন, নাকি এটাও সমাজের চাপে পড়েই এই হারটাকে তখনকার মতো দেখানো হলো?

শর্মিলা : এটা কাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে?

দর্শক : না, মানে আমাকে একটু এই জিনিসটা বুঝিয়ে দেন, এই হারটা কীসের জন্য? মানে উনার জেতার পোটেনশিয়ালিটি ছিলো, সবকিছু ছিলো, তা সত্ত্বেও সৌমিত্রকে উনি বলে দিলেন, আমি জিতলে কি ভালো লাগতো আপনার? মানে আমাকে এই মেমোরি গেমে কেউ কোনোদিন হারাতে পারেনি।

শর্মিলা : আপনি জিজ্ঞেস করছেন, আমি জেনেশুনে হেরে গেলাম মানে চরিত্রটা হেরে গেলো। এই যে হারটা, এটা কি অন্যদের প্রেসারে হলো, না মানে ...।

ঋতুপর্ণ : না, মানে ছেলেরা জিতবে, মেয়েরা হারবে¾এই জন্যই কি হলো, না অন্যকিছু?

শর্মিলা : না না, একেবারে উল্টোটাই হলো। কারণ মেমোরি গেমে অনেক ধরনের জিনিস হচ্ছিলো। আর সেখানে যখন আমি জেনেশুনে হেরে গেলাম, অসীম তো বুঝলো, সবাই বুঝলো যে, আমি জেনেশুনে হেরে গেলাম। তো জিতটা তো আমারই হলো।

অপর্ণা : কিন্তু কেনো তুমি জেনেশুনে হেরে গেলে?

শর্মিলা : বিকজ, ওর যে একটা দারুণ পম্পাসিটি, এতো পম্পাস, সেটাকে আমি বেশি পাত্তা দিলাম না; মানে আমার কাছে এটার কোনো মূল্য নেই। আমি এই লেভেলে তোমার সাথে কমপিট করতে চাই না। আমার হারলেও কোনো ব্যাপার নেই, জিতলেও কোনো ব্যাপার নেই।

ঋতুপর্ণ : না, একটা ডায়ালগেই আছে ছবিতে¾‘আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ভদ্রলোকের কনফিডেন্সটা একটু থেতো করে দি।’ এবং এটা তিন-চার বার হয়েছে। কুয়োতলায় স্নান করতে গিয়ে ওদের এমব্যারাসমেন্ট, মাতাল হয়ে ফিরছে রাত্রির বেলা¾এ সবকটা কথা যখন জেনে যান সৌমিত্র; যিনি অদিতিকে ইম্প্রেস করবার জন্য ভীষণ চেষ্টা করছেন, তাকে ওইটুকুন সুযোগ দেন অদিতি। এবং এটা একটা খুব সুন্দর জায়গা।

শর্মিলা : মানে ওটা কনফিডেন্সটাকে থেতলানোর জন্য, মানে ওই কম্পিটিশনটাকে আমি গ্রাহ্যই করলাম না। সেটাই বেশি বড়ো একটা ...।

ঋতুপর্ণ : মানে একদম উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেলো; না, আমার মনে নেই। এবার নেক্সট।

দর্শক : এই যে এখানে, তোমাদের সকলকে একসঙ্গে হয়তো আর পাবো না। তাই একটা প্রশ্ন করছি তোমাদের, যেটা হয়তো আলাদাভাবে করেছি কখনো তোমাদের।

মাধবী দি খুব সুন্দর করে বললেন যে, মেয়েদের ঘর থেকে বের করে আনা, রান্নাঘর থেকে বের করে আনা; যেটা মহানগর-এর কেমিস্ট। সেটা যেমন উনি [সত্যজিৎ] করেছেন এবং চারুলতায় শেষে দুটি হাত প্রায় মিলে আসছে, যেটা উনার কনট্রিবিউশন, সেই ...।

মাধবী : লাস্ট কাপুরুষ-এ তিন বার এসছিলো মেয়েটি, তিন বারই তাকে রিফিউজ করা হয়। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায়। চুপি চুপি ছেলেটি একবার জিজ্ঞেস করছে, করুণা তুমি ভালো আছো? করুণা সে কথার কোনো জবাব দেয়নি। ছেলেটির ঘুম আসছে না, তাকে স্লিপিং পিলস দিয়েছে; বলেছে, এটা খেয়ে ঘুমিয়ো, দুটোর বেশি নয় কিন্তু। তো ছেলেটি বলছে, যদি খাই? মেয়েটি বলছে, মনে তো হয় না। তারপর চলে গেছে। নেক্সট আবার গেছে ছেলেটি যখন চলে যাচ্ছে ট্রেনে তখন। সেই সময়ও বলছে যে, ওই ওষুধের শিশিটা দাও না, তখনো কিন্তু ছেলেটা বলতে পারলো না যে, এসো আমার সঙ্গে। এইভাবে তিন বারের তিন বারই তাকে কাপুরুষ দেখালো।

দর্শক : আমার প্রশ্ন পরের ট্রিলজি নিয়ে। সেভেনটিজের যে ছবিগুলো, যেখানে আমার বার বারই মনে হয়েছে, নারীচরিত্র সেখানে ইজ লাইক অ্যা ভয়েস অব কনসার্ন। সে নায়ক হোক বা সীমাবদ্ধ হোক, জন-অরণ্যতেও তা খুব প্রোনাউন্স ভাবে। তারপর থেকে আমরা যাচ্ছি ঘরে-বাইরে, যেখানে তার রেট্রিবিউশন হচ্ছে। তারপর শেষে যেটা বৈধব্য, যেটাকে পানিশমেন্ট হিসেবে দেখা ...।

অপর্ণা : তুমি যদি সেটাকে রেট্রিবিউশন হিসেবে দেখো ...।

দর্শক : হ্যাঁ, তবে আমার মনে হয়েছে, একটা ইনক্রিজিং, একটা মরালিস্টিক ভয়েস এসেছে। সেটা সম্বন্ধে ...।

ঋতুপর্ণ : মেয়েদের মধ্য দিয়ে এসেছে। ওই জন্য আমি বলছিলাম যে, এটাও একটা ওই ম্যাসকুলিন কনস্ট্রাক্ট যে, মেয়েদের মরালি সুপিরিয়র হতে হবে; যাতে মেয়েরা কোনো ইম্মরাল কাজ করতে না পারে। কারণ একদম শেষ ছবিতে [আগন্তুক] এই যে আউটসাইডার আসবে এবং সিস্টেমটাকে চ্যালেঞ্জ করবে, সেটার দায়িত্বটা কিন্তু উনি [সত্যজিৎ] দিলেন উৎপল দত্তকে। আগন্তুক-এ মনমোহন এলেন এবং তখনো আমরা দেখলাম যে, মমতা শঙ্কর এবং তার স্বামী দীপঙ্কর দে’র মধ্যে মমতা অনেক বেশি এক্সসেপ্টিং। একজন মহিলা, সে অতো বেশি সন্দেহ করছে না এবং ওইখানটাতে একেবারে মহিলা কুকি বানাতে পারেন, তিনি গয়না বের করছেন, গান গাইতে পারেন, মানে সেখানে নারীত্বের একটা ডিসপ্লে হলো। আসলে আমার মনে হয়, তার [সত্যজিৎ] শেষের ছবিগুলো নিয়ে কথা না বলাই বোধ হয় ভালো। কারণ আমরা একজন মাস্টারকে জাজ করবো তার মাস্টারপিসগুলো দিয়ে, তার নিকৃষ্ট কাজগুলো দিয়ে নয়। তাই শেষ তিনটি ছবি নিয়ে কথা না বলাই ভালো।

অপর্ণা : একজন পরিচালক সারাজীবনে যদি এতগুলো ছবি করে থাকেন, যেগুলো আমাদের চিরকাল মনে থাকবে। তাহলে আমারও মনে হয়, আমি ঋতুর সঙ্গে একমত, ওর যেগুলো মাস্টারপিস সেগুলো দিয়েই ওর বিচার হওয়া উচিত। (দর্শকের হাততালি)

মাধবী : সবগুলোই তো মাস্টারপিস।

ঋতুপর্ণ : সেখানেও যে কতোটা, মানে একদিকে চারুলতা, একদিকে অপু ট্রিলজি ...।

শর্মিলা : শুধু ছবি নয়, ছবি ছাড়াও তার যে কনট্রিবিউশন, হিজ মিউজিক, সবকিছুই তো উনি একা করলেন না। পরে বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সুব্রত মিত্র যাবার পর এর সবকিছু মানে গ্রাফিক্স, টু ফটোগ্রাফি, টু ওয়ারড্রৌব সবকিছু ...।

ঋতুপর্ণ : সেটা যে খুব ভালো হয়েছে তা নয়।

শর্মিলা : সেটা ডিবেটঅ্যাবল, আরেক দিন আরেকটা সেশনে।

ঋতুপর্ণ : তাহলে আমরা আজকে অনুষ্ঠান এখানেই শেষ করছি, অলরেডি অনেক রাত হয়ে গেছে।

দর্শক : আর একটা প্রশ্ন ছিলো। আপনারা বলছিলেন যে, কিছু কিছু জায়গায় তিনি মহিলাদের যে একটা আলাদা ভয়েস, সেটাকে বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোথাও কি জেন্ডার স্টেরিওটাইপ যেটা রয়েছে সমাজে, সেটা ভাঙার চেষ্টা হয়েছে? আপনি বলছিলেন ‘ফেলুদা’র কথা, যদি সত্যজিৎ রায়ের কিশোরসাহিত্য পড়ি, তাহলে পুরোটা নারী বর্জিত। শঙ্কু প্রফেসর ...।

ঋতুপর্ণ : আমরা তো বললাম সেটা। সেটা নিয়ে তো আলোচনা হলো। আপনি বোধ হয় পরে এসেছেন।

দর্শক : না না, পরে আসিনি। কিন্তু জেন্ডার স্টেরিওটাইপটা কি সত্যি উনি ভাঙার চেষ্টা করেছেন? সীমাবদ্ধতে, যেখানে ওই বার বার করে জিজ্ঞেস করছেন, এটা কি ভালো না খারাপ? এই একটা স্যাঙশন, একজন পুরুষের কাছ থেকে সেই স্যাঙশনটা চাওয়ার চেষ্টা ...।

ঋতুপর্ণ : আমরা কেনো ধরে নেবো মহিলা কেবল পুরুষের অ্যাপ্রুভালটা সিক করছে; একটা সারক্যাজম তো থাকতে পারে এটার মধ্যে। সেটা ভালো না খারাপ? আসলে ভালো খারাপ দিয়ে তো আর পৃথিবীকে জাজ করা যায় না।

শর্মিলা : আর সেটা শুধু এনডোর্সমেন্ট চাইছেন না; উনি জানতে চাইছেন, ওর কী বক্তব্য, তোমার রেন্টোস্পেকশনটা কোথায় যাচ্ছে? আর যখন মনে হচ্ছে লাস্ট স্টেজে উনি, তখন ইউ নো হি সোল্ড হিমসেল্ফ, তখন ওই ঘড়িটা খুলে মিলিয়ে যাচ্ছে, তাই না?

দর্শক : আমার একটা প্রশ্ন ছিলো, এই যে মিউজিক ডিরেক্টর ...।

ঋতুপর্ণ : দেখুন, আজকে তো সত্যজিতের নায়িকা নিয়ে কথা হচ্ছে।

দর্শক : না, আমি শুধু মিউজিক নিয়ে ...।

অপর্ণা : আসলে আজকে তো সত্যজিতের ছবিতে নারী আমাদের বিষয়বস্তু, সেজন্য বোধ হয় ঋতু ...।

শর্মিলা : মিউজিক নিয়ে কথা বলতে গেলে তো বাবা আরো এক ঘণ্টা লেগে যাবে। মিউজিকে তো তার দারুণ কনট্রিবিউশন।

ঋতুপর্ণ : সেখানে রবি শঙ্কর, আলী আকবর, বিসমিল্লাহ, বেলায়েত খান¾এদের প্রত্যেকের যে কনট্রিবিউশন সেগুলো এসে পড়বে। কারণ, সত্যজিৎ তিন কন্যা থেকে নিজের ছবির মিউজিক নিজে করতে শুরু করলেন। তার আগে অবধি তিনি শুধু মিউজিক ডিরেক্টর খোঁজেননি, বড়ো বড়ো ওস্তাদের কাছে গেছেন এবং বুঝিয়েছেন সিনেমার মিউজিকটা এমন একটা অদ্ভুত জিনিস, যেটা সত্যিকারের ভারতীয় মার্গসঙ্গীত দিয়ে বোধ হয় বলা যায় না। এজন্য উনি অনেক ইন্ডিয়ান ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করলেন আবার ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নও আনলেন। একটা কমপালসিটি তৈরি হলো। সত্যি ভারতীয় সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিন্তু সাবালক হলো সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে।

শর্মিলা : আর তাছাড়াও উনি শুধু ডিরেকশন আর স্ক্রিনপ্লের জন্য চার্জ করতেন; আর সবকিছু ফ্রি। কারণ উনার বাজেট ছিলো না, ইকুইপমেন্ট ছিলো না, লাইট ছিলো না। এবং অল দোজ স্টুডিওর ফ্লোর এতো খারাপ, ফুল অব পর্টহোলস যে, একটা ট্রলি শট্ হড়বড় করে যাচ্ছে। ভাবো, তোমরা তো ভাবতেই পারবে না, তোমরা তো (অপর্ণা ও ঋতুপর্ণকে লক্ষ্য করে) ওভাবে শুটিংই করবে না।

ঋতুপর্ণ : করেছি রে, অনেক করেছি।

অপর্ণা : এখনো কিন্তু খুব ভালো হয়নি রিঙ্কু।

শর্মিলা : তখন লোডশেডিং, তুমি ভাবো ল্যাবে প্রিন্ট করছো, পুরো সিনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লাইট ফ্ল্যাকচুয়েট করছে, মানে হার্ট অ্যাটাক হবে না তো কী হবে? অ্যান্ড ডিসপাইট দ্যাট হি ওয়াজ কমপিটিং উইথ কুরোসাওয়া, বার্গম্যান দ্য বেস্ট ইন ওয়ার্ল্ড।

অপর্ণা : আমার মনে হয়, এখানে আমরা এতো কথা বললাম, ওর ছবিতে কিন্তু সুব্রত মিত্র’র অবদানটা আমাদের ভোলা উচিত না।

শর্মিলা : সত্যি, অ্যাবসোলুটলি।

ঋতুপর্ণ : সুব্রত মিত্র, বংশী চন্দ্রগুপ্ত?

শর্মিলা : চারুলতায় বংশী দা, সুব্রত অ্যান্ড মানিক দা মিলে যে কনট্রিবিউশন ...। আর নায়ক, দ্য ব্যাক প্রজেকশন অব নায়ক।

ঋতুপর্ণ : একটা খুব মজার কথা মনে পড়লো। সুব্রত মিত্রের মা চারুলতা দেখে বংশী চন্দ্রগুপ্তকে ডেকে বললেন, কী ভালো কাজ করেছে বংশী! সুব্রত বললেন, আমি আলো না করলে ও ওই কাজটা দেখতে পেতো। (দর্শকের হাসি)

শর্মিলা : বংশী দা ওয়াজ ফ্যানটাসটিক।

অপর্ণা : এবং যেটা ভাবার বিষয় সেটা হচ্ছে, সুব্রত মিত্র তখন যে আলোগুলো তৈরি করেছিলেন সেটা এখনো ব্যবহার হয়। এখনো ব্যবহার হয় বাউন্স লাইটিং।

ঋতুপর্ণ : সত্যজিৎ রায় সামগ্রিকভাবে সিনেমায় অনেকগুলো আবিষ্কার আনলেন। ওর ন্যারেটিভ থেকেই তৈরি হয়ে গেলো অনেকগুলো জিনিস। যেগুলো টালিগঞ্জ বা ভারতীয় সিনেমা আগে দেখেনি। একেবারে পাইওনিয়ারিং কতোগুলো কাজ হলো। কিন্তু তা আর্টিস্টিকালি নয়, টেকনোলজিকালি।

শর্মিলা : অ্যাবসোলুটলি। বাউন্স লাইট, দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ইজ ফলোয়িং দ্যাট। আমরা যখন অরণ্যের দিনরাত্রির আউটডোরে তখন সকালে কেবল দুই ঘণ্টা শুটিং করতাম। কারণ ভীষণ গরম, এছাড়া কোনো উপায়ও ছিলো না। আর সৌমিত্র, শুভেন্দু, রবি দা অল অব আস আড্ডা মারতাম। অনেক সময় মানিক দা’র ওপর পলিটিকালি ইনকারেক্ট কথাবার্তা হতো। আর এগুলো যখন বংশী দা’র সামনে হতো, তখন তিনি বলতেন, ‘ও হো, মানিক ওরকম নয়। তোমরা কেনো এ রকমভাবে কথা বলছো, মানিক ইজ নট লাইক দ্যাট।’ আমরা বলতাম, তোমার মানিক, তোমার মানিক হ্যাজ ডান দিস ...।

ঋতুপর্ণ : ঠিক আছে, এখন শেষ না করলে মালা (আয়োজকদের একজন) আমায় মারবে। তো ঠিক আছে হয়ে গেলো।


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন